শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল হান্নান রঃ (পাগলার হুজুর) এর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ২০০৪ খৃস্টাব্দ থেকে। তখন তিনি জামেয়া ইসলামিয়া দারুল হাদিস জাউয়া মাদ্রাসার শাইখুল হাদিস পদে সমাসীন।উল্লেখ্য তিনিই জাউয়া মাদ্রাসার প্রথম শায়খুল হাদিস,তার হাত ধরেই জাউয়া মাদ্রাসার দরসে বুখারীর পবিত্র সূচনা হয়।
মাদ্রাসায় অধ্যায়নকালীন সময়ে আমার দেখা উলামায়ে কেরামদের মধ্যে হযরত ছিলেন সর্বোচ্চস্তরের। জ্ঞানের গভীরতার পাশাপাশি আমলের একনিষ্ঠতাই আমাকে তার প্রতি দুর্বল করে তুলেছিল।
কোমলহৃদয়ের অধিকারী এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ যোগ্যতার মাপকাঠিতে অনেক উঁচু দরজার হলেও আমার জানামতে অহংকার কখনও তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি বিনয় ও বিনম্রতার আদর্শ প্রতীক।
এটা কেবল আমি নয়,যে একবার তার সাহচর্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছে,সে তা স্বীকার করতে বাধ্য। আমি যখন জাউয়া মাদ্রাসায় মক্তব চাহারমে জামাতে লেখাপড়া করি,তখন একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেন তোমার নাম কী? কোথায় তোমার বাড়ি? কোন জামাতে পড়ো? কেননা মক্তব চাহারমে হুজুরের কোনো ক্লাশ ছিল না,তাই আমার সম্পর্কে তিনি সম্যক জ্ঞাত নন,আর এটা স্বাভাবিকই ছিল।
হুজুরের পরিচয়মূলক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একপর্যায়ে আমি বলি- হুজুর আমি হাফিজ মাও: ফারুক আহমদ ও মাও: সাঈদ আহমদ সাহেব এর ভাগ্না (তখন উনারা উভয়ই জাউয়া মাদ্রাসার শিক্ষক) বলতে গেলে তখন থেকেই হুজুর আমাকে চিনেন,আমি তার নজরে আসি। হুজুর মাদ্রাসায় রাতের বেলায় খুব কমই অবস্থান করতেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি বাড়ি থেকে এসেই মাদ্রাসায় পাঠদান করতেন।
মাদ্রাসায় অবস্থান করলে তিনি মাদ্রাসার দক্ষিণপার্শ্বে তার জন্য সংরক্ষিত রুমটাতেই থাকতেন,তার পাশের রুমেই থাকতেন আমার শ্রদ্ধেয় ছোট মামা মাদ্রাসার তৎকালীন শিক্ষাসচীব মাও: সাঈদ আহমদ (জাউয়ার হুজুর) সাহেব।
তার পরের রুমেই আমি বন্ধুবর আতিক, আব্দুল্লাহ, জামিল সহ আমরা প্রায় ৪/৫ জন থাকতাম। আব্দুল্লাহ জামিলের আব্বা মাদ্রাসার অন্যতম মুহাদ্দিস মাও: আব্দুল মান্নান সাহেব (বালিউরার হুজুর) থাকতেন এক রুমে।
এর পরের রুম হলো কুতুবখানা,যেখানে মুহতামীম সাহেবের (পাইগাঁও’র হুজুর) কার্যালয়,আর এরুমেই থাকতেন কুতুবখানার নাজিম হযরত মাও: মখলিছুর রহমান সাহেব (শাখাইতির হুজুর)।
হুজুর যেদিন মাদ্রাসায় থাকতেন,ফজরের নামাজ শেষ করেই দেখতাম তিনি কিতাব মুতা’আলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, কিছু সময় পরে হুজুর ডাক দিতেন জুবায়ের! অবায়দি আও! আহ…!!
এই আওয়াজ আজও কানে ভাসে। আমি তখন জি হুজুর বলে তার ডাকে সাড়া দিলে তিনি বলতেন- “চা খাবাও,বা রং চা সাথে একটা বন আর তুমি কিতা খাইতায় আনো!
(তখন বন রুটির মূল্য ছিল তিন টাকা) জি হুজুর! বলে আমি রেষ্টুরেন্ট থেকে চা আর বন নিয়ে হাজির হলে হুজুর বলতেন- “দাড়াও! এবং বনকে দ্বিখণ্ডিত করে অর্ধেক আমাকে দিতেন আর অর্ধেক তিনি খেতেন”।
খাওয়া দাওয়া শেষ হলে হুজুর বলতেন বিল কত? আমি বলতাম জি হুজুর! ৬টাকা। হুজুর তখন বাটা গেঞ্জির পাতলা পলিথিনের ব্যাগ থেকে ১০টাকার একটা নোট বের করে দিতেন। একদিন টাকা বের করতে দেরি হচ্ছে দেখে আমি বলে ছিলাম, হুজুর বিলটা আজ আমি দিয়ে দিই, হুজুর বললেন- না,জুবাইর! তুমি বিল দিতায় খেনে বা?
আমার কাছ থেকে নেও! এর পরে আর কোনো দিন বিল দেওয়ার স্বপ্নও দেখিনি বা বিল দেয়ার কথাবলার সাহসও পাইনি। হুজুরের নির্দিষ্ট কোনো খাদেম ছিলো না, কিন্তু হুজুরের পাশের রুমে খুব কাছাকাছি থাকার সৌভাগ্য হওয়ার কারণে আমাকেই তিনি বেশি ডাকতেন সকালের চা নাস্তা বা অন্য যেকোনো কিছুর জন্য।
হুজুরের লজিং ছিলো জাউয়া গ্রামের জনাব হারুন মিয়ার বাড়িতে, দুপুরের টিপিন এনে জগ নিয়ে যখন হাউজের মটর থেকে পানি নিয়ে আসতাম, হুজুর দরজার সামন থেকে আগাইয়া নিতেন, আর বলতেন অইছে বা অইছে, “আর লাগত নায় অইছে”। হুজুর খানার শুরুতে দস্তরখান নিজ হাতে বিছাইতেন, খানা শেষে দছতারকা নিজে উঠাইয়া রাখতেন,এটা খুব কম আলেমকেই আমি করতে দেখেছি।
নিজ চোখের দেখা, হুজুর নিজে নিজে রুম ঝাড়ু দিতেন, নিজের জামা কাপর নিজে ধুইয়ে দিতেন,এখন এগুলো কল্পনা করাও অসম্ভব। রুম ঝাড়ু দিতে দেখে একদিন গিয়ে বললাম হুজুর আমাকে দেন রুম ঝাড়ু দিয়ে দেবো। হুজুর বলেন- “না জুবাইর তুমি কেনে? আমি তো পারি বা” একদিনের ঘটনা ভুইগাঁও এর হুজুর ছিলেন নাযিমে তালিমাত, একদিন এক ছাত্রকে খুব মেরেছেন,তিনি জানতেন না তখন পাগলার হুজুর মাদ্রাসায় আছেন।
অবাক বিষ্ময়ে তখন তাকিয়ে দেখলাম, হুজুর কী যে রাগান্বিত হলেন! ধমক দিয়ে বলেছিলেন- “কে বলেছে এভাবে ছাত্র কে পেটাতে?.সেদিনকার রাগ দেখে ছাত্রদের প্রতি হুজুরের দরদ যে কতোটা তা অনুমান করতে মোটেও সমস্যা হয়নি। তারপর কোনো এক রমজানের পর খবর পেলাম,হুজুর আর জাউয়া মাদ্রাসায় নেই, শোনে আমি খুব মর্মাহত হলাম।
হঠাৎ একদিন জাউয়া বাজারের মহাসড়কে হুজুরকে দেখে দৌড়ে সামনে গেলাম, আমি সালাম দিলাম, সালাম গ্রহণ করলেন তারপর বললাম হুজুর আমি জুবায়ের… ছিনছি বা জুবাইর, ভালা আছোনি? আমি বললাম, জি হুজুর.. বুঝতে পারলাম হুজুর আমাকে চিনতে মোটেও ভূল করেননি, তখন হুজুরের হাতে থাকা ব্যাগটা আমার হাতে নিতে দেরি করলাম না।
হুজুর তখন বললেন,-“না বা জুবাইর ব্যাগ নেওয়া লাগবে না, আমি বাড়িত যাইতাম, জি হুজুর গাড়িত উঠাইয়া দিমু, আচ্ছা বা তে নেও, তোমার মামা তারা ভালানি? জি হুজুর ভালা আছেন।
এরপর আর হুজুরের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি,হঠাৎ একদিন শুনি,তিনি মাওলার ডাকে সাড়া দিয়ে পড়পাড়ে পাড়ি জমিয়েছেন,তখন মনে হয়েছিল যে,আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। আল্লাহ যেন তার প্রিয়বান্দার কবরকে রওজাতুম মিন দিয়ারিল জান্নাহ বানিয়ে দেন,আমিন।।
Leave a Reply